১৫ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩১শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

EN

বাঁশি কই আগের মতো বাজে না

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ৫:১৪ অপরাহ্ণ , ১৫ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার , পোষ্ট করা হয়েছে 8 years আগে

মনের কামনাগুলো জ্বলে নিভে যায় শিমুলের শাখে শাখে, চৈত্র-নিশীথে বসন্ত কাঁদে দেখি দূরে বৈশাখে।’ নিজেরই লেখা কবেকার গানটি মনে পড়ে গেল। ফুল ঝরে গেলেও কামনা-বাসনা ঝরে যায় না। ঋতুবৈচিত্র্যে ঘুরেফিরে আসে বাংলা নববর্ষ। প্রথম মাস বৈশাখ। বাঙালির প্রিয় পয়লা বৈশাখ। জনে-জনে সুরেলা শুভেচ্ছা।
স্বাধীনতা উত্তরকালে আমাদের সংস্কৃতি-অঙ্গনে পয়লা বৈশাখ উদযাপন একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়। পার্বত্য তিন জেলা- রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান উপজাতিদের প্রধান সামাজিক উৎসব বাংলা-নববর্ষ বরণ। যার নাম ‘বৈসাবি’।
গ্রামগঞ্জের মতো বর্ষবরণের চমকপ্রদ আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। উৎসবের অনুষ্ঠানমালা সৃষ্টি করে এক অপূর্ব মিলনমেলা। শিশুরা খেলছে। বড়রা বেড়াচ্ছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা কূজনে মগ্ন। খুশিতে, লাবণ্যে-মাধুর্যে পুরো পরিবেশ ঝলমল করে ওঠে। ওরা না থাকলে যেন মিথ্যে হতো আকাশের তারা ফোটা, মিথ্যে হতো জীবনের মানে।
উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। রমনা উদ্যান, চারুকলা ইস্টিটিউটের বকুলতলা, শহীদ মিনার, টিএসসি এলাকাজুড়ে বিশাল জনসমুদ্রে প্লাবিত। নির্জন দিনের স্রোতে ওরা ভেসে আসে ফুলের মতো। শৈশব এবং মধ্যবয়স অনায়াসে মিশে যেতে পারে। কিন্তু সবুজ আর নীলিমার কান্তির পাশাপাশি জেগে থাকে বিমূর্ত এক নৈরাজ্য, যেখানে শরীর আছে মন নেই। পয়সা আছে সম্পদ নেই। সোহাগ আছে আদর নেই। ফুর্তি আছে প্রাণ নেই।
বাংলা একাডেমি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মসূচির মধ্যে প্রধান আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। মেলা নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে। এটি মূলত সর্বজনীন লোকজ মেলা। কী নেই সেখানে! স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব ধরনের হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী। শিশু-কিশোরদের রকমারি খেলনা, মহিলাদের সাজসজ্জার সামগ্রী। থাকে লোকজ খাদ্যদ্রব্য চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা। বৈচিত্র্যময় এক সমারোহ জমে ওঠে বৈশাখী মেলায়। থাকে বিনোদনের ব্যবস্থাও। দিনভর ইঁদুরদৌড় শেষে সংসারজীবী মানুষের ঢল নামে। দখিনা হাওয়া যেন বয়ে আনে দাক্ষিণ্যের সুসংবাদ।
কাল, তুমি আলেয়া! বেঁচে থাকার রসায়ন বড় জটিল। রহস্যময়ও বলা যায়। দূর থেকে ওই সব দেখেশুনে প্রবীণরা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত। সুকণ্ঠী প্রতিমা ব্যানার্জির উদাস করা গানটিÑ ‘আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। বাঁশি কই আগের মতো বাজে না, মন আমার তেমন কেন সাজে না, তবে কি ছেলেবেলা অ-নে-ক দূরে ফেলে এসেছি’! সত্যি তো কোথায় সেই ছেলেবেলা, কোথায় কিশোরকাল! আবহমানকাল থেকে তুলে আনা সেইসব টুকরো-টুকরো ছবি ভেসে ওঠে যখন প্রবল কষ্ট পাই। ওই আকাশ বাউরি বাতাস নদীজল আমায় কি ফিরিয়ে দেবে স্মৃতিবিদ্ধ আঁতুড়ঘর!
গ্রাম ছেড়ে একসময় চলে এলাম রাজধানী ঢাকায়। পেছনে রয়ে গেল প্রিয়বন্ধু গাছ মাটি ঘাস। অনন্ত অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে আসা জীবন। জীবন মানে তো এ ভাবেই খুঁজে যাওয়া। স্মৃতি-বিস্মৃতির কুয়াসাজাল ছিঁড়ে ছেলেবেলার কত জলছবি বড়বেলায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে পড়ে গ্রামের সেই উদাসকরা নকশিকাঁথার মাঠ। মাঠজুড়ে রকমারি বৈশাখী মেলা। দৃষ্টিনন্দিত হরেকরকম হস্তশিল্প। ছোটদের জন্য মনকাড়া পুতুল, বাঁশি। কত রকমের মিষ্টিজাত দ্রব্য। নিত্যদিনের গৃহসামগ্রী। মনের থেকে আজ সেইসব ছবি হারিয়ে ফেলেছি।
অবশ্য গ্রামও এখন অনেক পাল্টে গেছে। দোতলা, তিনতলা, চারতলা পাকা বাড়ি। সবকিছু অচেনা অজানা অবিশ্বাস্য। কৃষকের ছেলে। হাতে মোবাইল নিয়ে বাইক চালাচ্ছে। দেশের পয়সায় নয়, আমদানি করা সম্পদ। অনেক ছেলেই আরব দেশ তথা বিদেশে চাকরি করে। রিয়াল আর ডলারের যেন কমতি নেই।
যা হোক, রক্তের ভেতর গুপ্ত প্রাণ। স্মৃতিকে ফিরে ফিরে দেখি। শৈশব-কৈশোরের কত স্বপ্ন, কত উত্তেজনা, কত উন্মোচন থেকে গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ জীবন। কিন্তু এখন জীবন আর সময় হেলেদুলে হাত ধরে হাঁটছে, ছুটে পালাচ্ছে না।
মাঝে মাঝে শহরের রাজপথে জেগে ওঠে বনজ বাহার। পালিয়ে যাওয়ার মতো স্মৃতি এসে দরজায় দাঁড়ায়। শ্রীমতি বাতাসে মন উড়–উড়–। ওই তো দূরে সবুজ চত্বরে কয়েকটা গাছ, পুরনো একটা বেঞ্চ-আমি আর আমার চেনা সহচর কৈশোর কী সুন্দর মুখোমুখি বসে আছি। অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে সহসা আমরা যেন ভেসে এলাম যুগল আনন্দস্রোতে!
শৈশব থেকে রন্দ্রে রন্দ্রে মিশে যাওয়া গূঢ় এক অনিশ্চয়তাবোধ বুঝি পিছু ছাড়ে না। জীর্ণ শাখায় গজায় প্রাণ। এ শহর ছেড়ে যেতেই হবে বহুদূর-এমন দূর যেখানে বাড়ি আছে, ঘর আছে, মানুষ আছে, প্রাণী আছে, ক্ষেত আছে, পুকুর আছে, নদী আছে। নেই শুধু দীঘি আর বাল্যসখি।
নিস্খবর শূন্যতায়, নিরাত্মীয় দূরত্বে যখন রাতের আকাশের মুখোমুখি হই, তারাগুলি মিটমিট করে। বলছে ‘তাড়া কিসের’? এই স্বাদু পৃথিবীর মায়াবী আলোয় পদ্মাসনে বসে আছেন ধ্যানস্থ মহাকাল!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

July 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  
আরও পড়ুন