২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

EN

সরাইলের বিখ্যাত হাউন্ড কুকুর বিলুপ্তির পথে

বার্তা সম্পাদক

প্রকাশিত: ৬:২৮ অপরাহ্ণ , ৫ জুন ২০১৭, সোমবার , পোষ্ট করা হয়েছে 6 years আগে

মাহবুব খান বাবুল ও এম এ করিম, সরাইল নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গ্রে-হাউন্ড কুকুর এখন বিলুপ্তির পথে। দেশ-বিদেশে এ কুকুরের বেশ কদর থাকলেও কুকুর পালনে পর্যাপ্ত খরচের প্রভাব, কুকুর চুরের উপদ্রুপ বৃদ্ধি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা কারনে এতিহ্যবাহী এ কুকুর দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সৌখিন লোকজনও কুকুর পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সরাইলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে স্থানীয় কিছু মুচি পরিবার এ কুকুর লালন পালন  করলেও দিন দিন তাদের সংখ্যাও কমে আসছে। গোটা উপজেলায় মাত্র ১টি মুচি পরিবার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনো রকমে এ কুকুর লালন পালন করছে। সরাইলের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ মূল্যবান এই প্রজাতির কুকুরকে বাঁচিয়ে রাখা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া অসম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা।  চাহিদা, প্রয়োজন ও সুনামের কথা চিন্তা করে সরকারি ভাবে এ কুকুরের খামার করা হয়েছিল। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।  জানা যায়, বৃটিশ আমলে ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। আনন্দ বিনোদনের জন্য সেখানে নানা ধরনের ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হতো। গ্রে-হাউন্ড দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল অন্যতম। কুকুরগুলো ঘণ্টায় ৪০ মাইল বেগে স্প্রিং-এর মতো দৌড়ায়। চিতাবাঘ, ঘোড়া, সিংহ ও ক্যাংগারুর পরই গ্রে-হাউন্ডের স্থান। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সরাইলের দেওয়ান  মোস্তফা আলী কলকাতা থেকে গ্রে-হাউন্ড কুকুর নিয়ে আসেন। তখন থেকেই সরাইলে শুরু হয় প্রাণী জগতের বিস্ময় অসাধারণ গুণাবলীর অধিকারী এই গ্রে-হাউন্ড কুকুরের লালনপালন। কথিত আছে একসময় একটি মাদী কুকুর জমিদারের সঙ্গে শিকারে গিয়ে জঙ্গলে থেকে যায়। সেখানে বাঘের সঙ্গে মাদী কুকুরের মিলন ঘটে। ফিরে এসে কয়েক মাস পর বাচ্চা প্রসব করে। আস্তে আস্তে এ কুকুর নতুন প্রজাতি রূপে আবির্ভূত হয়। প্রভুভক্ত, প্রখর ঘ্রাণ শক্তি, শিকারে পারদর্শিতা ও অদম্য সাহসিকতার কারণে দেশ-বিদেশে সরাইলের হাউন্ড কুকুর দ্রুত পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বকোষে লেখা হয়ে যায়, সরাইল গ্রে-হাউন্ড কুকুরের জন্য বিখ্যাত। চাহিদা, দাম ও কদর বেড়ে যায় এখানকার কুকুরের। অনেকে শখের বশে কুকুর পোষতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে স্থানীয় কিছু মুচি পরিবারের লোকজনও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাউন্ড কুকুর পোষা শুরু করে। কুকুরের ১টি বাচ্চা ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হয়েছে। এখনো হচ্ছে। তবে, অধিক খরচ, শ্রম ও চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে সৌখিন লোকজন এখন কুকুর পোষা বন্ধ করে দিয়েছেন। জায়গা ও অর্থের অভাবে কুকুর পোষা গুটিয়ে ফেলেছে অনেকগুলো দরিদ্র মুচি পরিবার। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সরকার উপজেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় স্থানীয় সমাজকল্যাণ দপ্তর ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরের যৌথ তত্ত্বাবধানে ইউনিয়ন পরিষদের পশ্চিম পাশে হাউন্ড কুকুরের একটি খামার চালু করেছিল। আর্থিক সংকটসহ নানাবিধ কারণে ১৯৮৮ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। অদ্যাবধি সেই খামারটি সরকারি ভাবে আর চালু হয়নি। ২০০১ সালে বড় দেওয়ানপাড়ার ড. শাহজাহান ঠাকুর সরাইল বিশ্বরোডের পাশে নন্দনপুরে এ কুকুরের পরিশুদ্ধ বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি প্রজনন প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিন বছর পর সেটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এখনো এ প্রজাতির (ক্রস জাত) ৩-৪টি মাদী কুকুর পোষছেন নোয়াগাঁও ইউনিয়নের চওড়াগোদা গ্রামের মুচি পরিবারের সদস্য মহন লাল । ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপর্যাপ্ত খাবার ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়েই দীর্ঘদিন ধরে এ কুকুর পোষছেন তপন। এখানে ক্রসের মাধ্যমে চলছে প্রজননের কাজ। ফলে প্রকৃত হাউন্ড কুকুরের উচ্চতা, মুখ,  লেজ ও কানের আকৃতি নেই এগুলোর। নেই গতি ও  পূর্বের চাকচিক্য । চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার পথে মূল্যবান এ প্রজাতি। বর্তমানে কোনো রকমে এগুলোকে হাউন্ড বলেই চালানো হচ্ছে। তপন বলেন, আমরা গরিব। তিন বেলার আহার যোগাড় করতে পারি না। জায়গাও নেই। একটি কুকুরকে দৈনিক ৫ শ’ টাকার খাবার দিতে হয়। কত লোকজন আসে। ছবি ওঠায়। ভিডিও করে। সরকার আমাদের কিছু দেয় না। তারপরও কোনো রকমে ৩০-৪০ বছর ধরে কুকুর পোষে যাচ্ছি। বছরে ৫-৬টি বাচ্চা বিক্রি করতে পারি। আমাদের পূর্ব পুরুষরা কুকুর পোষতো। তাই আমরাও পোষছি। উপজেলার নিজসরাইলের বাসিন্দা শরীফ আব্দুল্লাহ ওরওফ রানা মিয়া শখের বশে একটি হাউন্ড কুকুর দীর্ঘদিন ধরে আদর-সোহাগ দিয়ে লালন-পালন করে বড় করেছিলেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো কুকুরটি কে বা কারা চুরি করে নিয়ে যায়। সেই ক্ষোভে হাউন্ড কুকুর লালন পালন করার ইচ্ছা শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন বলেন জানান তিনি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সৌখিন লোকজন সরাইলে এসে হাউন্ড কুকুর সন্ধান করতে দেখা গেলেও উপজেলার হাতে গানা ১/২টি স্থান ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না ঐতিহ্যবাহী এ হাউন্ড কুকুর। কালের পরিক্রমায় সরাইলের হাউন্ড কুকুর এখন বিলুপ্তির পথে। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২(সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা বলেন তৎকারীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সরকারের সময় সরাইলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হাউন্ড কুকুর ও হাসঁলী মোরগের খামার ছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আজ সেই খামার বিলুপ্ত। সরাইলের ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে বর্তমানে সরকারিভাবে সরাইলে হাউন্ড কুকুর ও হাসঁলী মোরগের খামার পুন: স্থাপনের জন্য ক্ষামি মহান জাতীয় সংসদে কথা বলেছি। এ ব্যাপারে মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আমি সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রক্ষা করতেছি। আশা করি সরাইলের ঐতিহ্যবাহী গ্রে-হাউন্ড কুকুর ও হাঁসলী মোরগ সংরক্ষনের জন্য  শীঘ্রই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই খামার স্থাপন করা হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আর্কাইভ

September 2023
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930  
আরও পড়ুন